জাতক

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা - | NCTB BOOK
10
10

এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব -

■ জাতক পরিচিতি ও জাতকের সংখ্যা; 

■ জাতকের প্রভাব; 

■ সুখ বিহারী জাতক ।

রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ ধর্মসেন ভিক্ষু ধর্মদেশনার সময় প্রায়ই জাতক বলেন। দায়ক-দায়িকারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর দেশনা শুনেন। একদিন এক দায়িকা তাঁকে বললেন, ‘ভন্তে ! আপনি যখন জাতক বলেন তখন খুব ভালো লাগে। এতে আমরা সৎ ও নৈতিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হই।' তখন ধর্মসেন ভিক্ষু বললেন, ‘বুদ্ধ ধর্মোপদেশ দেওয়ার সময় জাতক বলতেন। মানুষকে নৈতিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি জাতক ভাষণ করতেন। আজ আমি আপনাদের জাতক কী, জাতক শুনলে বা পাঠ করলে কী উপকার হয় তা বলব। এছাড়া দুটি জাতকও ভাষণ করব। এরপর তিনি প্রথমে জাতক সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য বলেন :

জাতক পরিচিতি

জাতক শব্দটি ‘জাত’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘জাত’ শব্দের অর্থ হলো উৎপন্ন, উদ্ভূত, জন্ম ইত্যাদি। সুতরাং ‘জাতক’ শব্দের অর্থ হলো যিনি উৎপন্ন বা জন্ম লাভ করেছেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের অতীত জীবন বোঝাতে ‘জাতক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বুদ্ধ ধর্ম দেশনার সময় এবং বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষ্যে শিষ্যদের তাঁর অতীত জন্মের কাহিনি বর্ণনা করতেন। জাতক পাঠে জানা যায়, জন্ম জন্মান্তরে গৌতম বুদ্ধ বিভিন্ন প্রাণী হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজা, মন্ত্রী, ব্রাহ্মণ, বণিক, দেবতা, পশু, পাখি, মৎস্য প্রভৃতি নানা রূপে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, তিনি ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিটি জন্মে তিনি ‘বোধিসত্ত্ব' নামে অভিহিত হতেন। কোনো জন্মে তিনি দান পারমী, কোনো জন্মে শীল পারমী, কোনো জন্মে প্রজ্ঞা পারমী পূর্ণ করেন। এভাবে তিনি দশ পারমী পূর্ণ করে শেষ জন্মে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্মের সেই কাহিনিগুলো ‘জাতক’ নামে পরিচিত। বর্তমানে ৪৪৭টি জাতক পাওয়া যায়। ৩টি জাতক পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, সেগুলো হারিয়ে গেছে। জাতকগুলোতে গৌতম বুদ্ধের অতীত জীবনের কুশল কর্ম সম্পাদনের কথা উল্লেখ আছে। জাতক পাঠে সেইসব কুশল কর্মের কথা জানা যায়। তাই জাতক পাঠের উপকারিতা অনেক । জাতকের প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ হলো - জাতকগুলো মানুষকে কর্মফল সম্পর্কে সচেতন করে। কুশল কর্ম সম্পাদন এবং নৈতিক ও মানবিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্মের মর্মবাণী এবং জটিল ও কঠিন বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরে। এ কারণে মানব জীবনে জাতকের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর ধর্মসেন ভিক্ষু মানব জীবনে জাতকের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা শুর করেন এবং বলেন -

 

জাতকের প্রভাব

ভালো কাজের সুফল আর খারাপ কাজের কুফল সম্পর্কে বোঝানোর জন্য গৌতম বুদ্ধ জাতকগুলো ভাষণ করতেন। তাই সুন্দর জীবন গঠনে জাতকের প্রভাব আছে। জাতকের কাহিনিগুলো মানুষকে সৎ, আদর্শবান, নীতিবান, মৈত্রীপরায়ণ,, পরোপকারী, এবং মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। কারো প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, মিথ্যাবলা, কর্কশ ও কটু বাক্য বলা, চুরি করা, মাদকদ্রব্য সেবন প্রভৃতি থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। লোভ, তৃষ্ণা, বিদ্বেষ প্রভৃতি ক্ষয় করতে অনুপ্রাণিত করে। সম্যক জীবিকা দিয়ে জীবন নির্বাহ বা পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে উৎসাহ যোগায়। সকল প্রাণীর কল্যাণ সাধন এবং আর্ত-মানবতার সেবার নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা দেয়। এক কথায় বলা যায়- নৈতিক, মানবিক ও আদর্শ জীবন গঠনে জাতকের প্রভাব অপরিসীম।

জাতক পাঠে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সমাজে বহু মানুষ দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় এবং জীব-জন্তুর নিরাপত্তায় কাজ করছেন। যদি আমরা জাতকের শিক্ষা গ্রহণ করে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের মনোভাব সৃষ্টি করতে পারি; অপরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি চিন্তা করতে পারি; জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি মৈত্রী-করুণা প্রদর্শন করতে পারি, তাহলে আমরা একটি সুখী ও সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

এরপর ধর্মসেন ভিক্ষু বলেন, বর্তমানে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ ভোগের আশায় অস্থির। যার যত বেশী আছে, সে আরো তত বেশী চায়। তাই পৃথিবীতে লোভ, অন্যায়, অবিচার, ঘুষ ও দুর্নীতি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এর ফলে সামাজিক পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে একদিকে মানুষ নীতি আদর্শ হারাচ্ছে, অপরদিকে গাছ-পালা, পশু-পাখি, জীবজন্তুর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে পরিবেশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারছে না, ‘ভোগে শান্তি নেই, ভোগে দুঃখ বাড়ায়। ত্যাগেই একমাত্র শান্তি।' এ কথাটি সহজভাবে বোঝানোর জন্য ধর্মসেন ভিক্ষু দু'টি জাতক ভাষণ করেন।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ২৯

জাতকের কাহিনিগুলো থেকে আমরা কী কী শিক্ষা লাভ করতে পারি, তার একটি তালিকা তৈরি করো।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

সুখ-বিহারী জাতক

পুরাকালে বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব এক ব্রাহ্মণকূলে জন্মগ্রহণ করেন। ঘর সংসার খুব দুঃখময়, গৃহত্যাগ বরং সুখকর - এই ভেবে তিনি হিমালয়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। অবশেষে তিনি ধ্যান করে আট রকম ধ্যানফলের অধিকারী হন। তাঁর শিষ্য হন পাঁচশ তপস্বী ।

একবার বর্ষাকালে বোধিসত্ত্ব শিষ্যসহ হিমালয়ে গিয়ে পৌছেন। সেখান থেকে নগরে ও জনপদে ভিক্ষা করতে করতে বারাণসীতে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি রাজার উদ্যানে অতিথি হয়ে বর্ষার চার মাস কাটিয়ে দেন। তারপর তিনি বিদায় নেওয়ার জন্য রাজার কাছে গেলেন। রাজা বললেন, আপনি বুড়ো হয়েছেন। এই বয়সে আপনি হিমালয়ে ফিরে যাবেন কেন? শিষ্যদের হিমালয়ে আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে আপনি এখানে থাকুন।

রাজার অনুরোধে তিনি রাজি হলেন। তখন তিনি জ্যেষ্ঠ শিষ্যকে বললেন, তোমার ওপর পাঁচশত শিষ্যের দেখাশোনার ভার দিলাম। তুমি তাদের নিয়ে হিমালয়ে চলে যাও। আমি এখানে থাকব।

বোধিসত্ত্বের এই জ্যেষ্ঠ শিষ্য ছিলেন এক রাজা । রাজত্ব ছেড়ে এসে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। তিনি গুরুর আদেশ পেয়ে শিষ্যদের নিয়ে হিমালয়ে চলে যান। সেখানে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তিনি শিষ্যদের বললেন, “তোমরা ভালোভাবে থেকো। আমি একবার আচার্য গুরুদেবকে বন্দনা করে আসি।’

এই বলে বারাণসীতে গিয়ে আচার্যকে বন্দনা করে পাশে একটি মাদুর পেতে শুয়ে পড়লেন । ঠিক এ সময় তপস্বীর সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজাও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তপস্বীকে বন্দনা করে এক পাশে উপবেশন করলেন। নবাগত তপস্বী রাজাকে দেখেও বিছানা থেকে উঠলেন না। আয়েশ করে শুয়ে থেকে তিনি বলতে লাগলেন, “আহা কী সুখ।' রাজা নতুন তপস্বীকে বন্দনা করার পরও তপস্বী উঠলেন না। রাজা ভাবলেন তপস্বী বোধ হয় তাকে অবজ্ঞা করছেন। কাজেই তিনি একটু বিরক্ত হলেন। তিনি বোধিসত্ত্বকে বললেন, ‘প্রভু, এই তপস্বী বোধ হয় খুব বেশী মাত্রায় আহার করেছেন। তা না হলে এভাবে আহা কী সুখ বলেছেন কেন?”

বোধিসত্ত্ব বললেন, মহারাজ, এই তপস্বী আগে আপনার মতো রাজা ছিলেন। কিন্তু তপস্বী হয়ে এখন তিনি যে সুখ পেয়েছেন, তা রাজ্যসুখ ভোগ করার সময় পাননি। রাজ্যসুখ তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ধ্যান সমাধির বিমল সুখে তিনি এখন বিভোর। সেজন্যই হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে এ রকম বলেছেন। কামনা বাসনা যার মধ্যে নেই তিনিই প্রকৃত সুখী। তিনি কারও ছায়ায় নিজেকে রক্ষা করার কথা ভাবেন না, নিজের কিছু রক্ষা করার জন্যও চিন্তিত হন না।

এই ধর্ম উপদেশ শুনে রাজা বোধিসত্ত্বকে প্রণাম করে প্রাসাদে চলে গেলেন। তপস্বীও বোধিসত্ত্বকে বন্দনা করে হিমালয়ে ফিরে যান। বোধিসত্ত্ব বারাণসীতে থেকে গেলেন। তিনি প্রাপ্ত বয়সে পূর্ণ জ্ঞানে দেহত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন।

 

উপদেশ : ত্যাগেই সুখ, ভোগে সুখ নেই।

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩০

সুখবিহারী জাতকের আলোকে কীভাবে তুমি নিজ জীবন গড়তে চাও বর্ণনা করো (একক কাজ)

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩১

কেস স্টাডি : নিচের দৃশ্যপট দু'টি পড়ার পর নিম্নলিখিক প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও ।

দৃশ্যপট-১দৃশ্যপট-২
একগ্রামে একজন লোক অতীব ধর্মপরায়ণ। সৎ জীবিকা দ্বারা তিনি সন্তান-সন্ততি নিয়ে সুখে দিন যাপন করেন। তার কোনো লোভ-লালসা নেই। সব সময় ত্যাগের মনোভাব নিয়ে চলেন। অতি বেশী ধন-সম্পদ লাভের দিকে তাঁর প্রচেষ্টা নেই। সৎপথে থেকে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।ঐ গ্রামে আরেকজন ব্যক্তি আছেন যিনি প্রচুর ধন- সম্পত্তির মালিক। প্রতিনিয়ত তার ধন-সম্পত্তির দিকে লোভ। মানুষকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করে সে শুধু নিজেই বিত্তশালী হতে চায়। ধর্ম-কর্মের প্রতি তার কোনো চেতনা নেই। তার সন্তানরাও তার মতো হয়ে গড়ে উঠছে।

 

 

 

 

 

 

ক) দৃশ্যপট-১ ও দৃশ্যপট-২ এর মধ্যে কে ত্যাগী?
 
 
 
খ) প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য কী?
 
 
 
গ) দুই ব্যক্তির মধ্যে তুমি কাকে বেশী শ্রদ্ধা করবে। ব্যাখ্যা করো।
 
 
 
ঘ) প্রথম ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করলে সমাজের কী উপকার হবে-যথাযথ ব্যাখ্যা দাও।
 
 
 
 

সুখবিহারী জাতক বর্ণনা করার পর উপস্থিত সবাই সাধুবাদ প্রদান করেন।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩২

গল্প বলা ও কেস স্টাডি অভিজ্ঞতাটি সম্পর্কে তোমার লিখিত মতামত দাও।

                                           অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম : গল্প বলা ও কেস স্টাডি

কার্যক্রমের কী কী ভালো লেগেছে (ভালো দিক)

 
 
 
কার্যক্রম করতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছ, (প্রতিবন্ধকতাসমূহ)
 
 
 
সমস্যা নিরসনে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?
 
 
 
ভবিষ্যতে আর কী কী উন্নয়ন করা যায় (পরামর্শ)
 
 
 
 

 

ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না ঘরে (√) চিহ্ন দাও:

অংশগ্রহণমূলক কাজ নং                                            সম্পূর্ণ করেছি
হ্যাঁনা
২৫  
২৬  
২৭  
২৮  
২৯  
৩০  
৩১  
৩২  

মন দিয়ে জাতক পড়ি, সৎ গুণের চর্চা করি।।

Content added By

Read more

Promotion